প্রবন্ধ /ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ

4

 

বিশ্বজিৎ রায়

সিমলেপাড়ার নরেন্দ্রনাথ দত্ত খেলাধুলোয় বেশ পটু ছিলেন, তাঁর থেকে বছর দুয়েকের বড় পাশের পাড়ার রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ততটা পটু ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ ক্রিকেট খেলছেন, এমন দৃশ্য বাঙালি কল্পনা করতেও দ্বিধা করবেন ডাকাবুকো সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের মতো ছেলেবেলায় দলবেঁধে না খেললেও খেলাধুলোয় রবীন্দ্রনাথের অনাগ্রহ ছিলএকথা কিন্তু সত্য নয় অকালপ্রয়াত বিবেকানন্দ ইশকুল গড়ে যেতে পারেননি, সন্ন্যাসীদের মঠ তৈরি করেছিলেন গীতা পাঠের নামেতামসিক আলস্যকে প্রশ্রয় দেওয়ার চাইতে ফুটবল খেলার তৎপরতা যে দেশদশের পক্ষে মঙ্গলজনক বিবেকানন্দ সেকথা মানতেন, গুরুভাইদেরও তা বলতেন আর রবীন্দ্রনাথ? ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে বিবেকানন্দের প্রয়াণের সময় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম সবে তৈরি হয়েছে  ক্রমে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে খেলাধুলোর নানা উদ্যোগ আয়োজন করা হয়েছিলতাতে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ মদত ছিল তাঁর নিজের ছেলেবেলায় খেলাধুলোর সুযোগসুবিধে অবশ্য তেমন ছিল না, ঊনবিংশ শতাব্দীতে মহাবিদ্রোহ পরবর্তী কালে ইংরেজ উপনিবেশের সে তখন সকালবেলা

ছেলেবেলা’- স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘তখন খেলা  ছিল সামান্য কয়েক রকমের ছিল মার্বেল, ছিল যাকে বলে ব্যাটবলক্রিকেটের অত্যন্ত দূর কুটুম্ব আর ছিল লাঠিমঘোরানো, ঘুড়িওড়ানো শহরে ছেলেদের খেলা সবই ছিল এমনি কম্জোরি মাঠজোড়া ফুটবলখেলার লম্ফঝম্ফ তখনো ছিল সমুদ্রপারে এমনি করে একই মাপের দিনগুলো শুকনো খুঁটির বেড়া পুঁতে চলেছিল আমাকে পাকে পাকে ঘিরেবিশ শতকে ভারতীয়রা ফুটবলক্রিকেট এদেশে প্রচলিত জনপ্রিয় হওয়ার সূত্রে ইংরেজদের সঙ্গে এই দুই খেলায় পাল্লা দেওয়ার কথা ভাবল ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ফুটবলক্রিকেটের বালাই যেমন ছিল, তেমনই মেয়েরাও যাতে খেলাধুলোয় শরীরচর্চায় যোগ দেয় সেবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনোযোগ যথেষ্ট, টেনিসের আয়োজন করা হয়েছিল ছেলেদের খেলা নিয়ে তিনি কতটাসিরিয়াসতার প্রমাণ মেলে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে লেখা একটি চিঠিতে বর্ষাকাল আউটডোর গেমস বন্ধ ১৩ জুলাই, ১৯১১ বোলপুর থেকে উৎকণ্ঠিত রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘প্রশান্ত ছেলেদের খেলার কি করলে ? মেঘ হচ্চে, বৃষ্টি পড়চে, ছেলেদের মন ছটফট করচেওদের হাতে কিছু দিতে হবে আর কিছু খুঁজে বের করা এবং ভেবে ঠিক করা যদি সম্ভব না হয় তাহলে কয়েক সেট্ চরহম চড়হম পাঠিয়ে দিয়ো ওটা সব ছেলেরই খুব ভাল লাগেতবে রবীন্দ্রনাথের মন তো কেবল খেলার উদ্যোগেই, শরীরের নির্মাণেই আটকে থাকেনিতিনি ক্রিকেট ভাবুকও বটে, ক্রিকেটের রাজনীতি আর ক্রিকেটের সমাজনীতি দুটি বিষয়েই মাথা ঘামিয়েছিলেন তার প্রমাণ রবীন্দ্ররচনার মধ্যে ছড়িয়ে আছে

বিশ শতকে ফুটবলক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় বনাম সাহেবদের লড়াই শুধু খেলার মাঠের লড়াই নয় জাতীয়তাবাদী লড়াইয়েরই প্রতিরূপ খেলার মাঠ জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উস্কে দিচ্ছেমোহনবাগানের বাঙালি খেলুড়েরা খালিপায়ে খেলে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে গোলে যখন হারিয়ে দিল, অভিলাষ ঘোষের জয়সূচক গোল তখন কেবল মাঠের জয় নয়স্বদেশচেতনার জয়  ঘটনা ১৯১১ সালের তার আগেই রবীন্দ্রনাথেরগোরাউপন্যাস লেখা হয়ে গেছে সেখানে অবশ্য ফুটবল নয়ক্রিকেটই  জাতীয়তাবাদের উদ্দীপক রবীন্দ্রনাথগোরাউপন্যাসের মধ্যে যেন একালেরলগানসিনেমার পূর্বসূত্র ধরা দিচ্ছে গোরা জন্মসূত্রে বিদেশি কিন্তু বড় হয়েছে ভারতীয় পরিবারে তার জন্মরহস্য যখন অজানা সেই পর্বেভারতবর্ষনামের দেশটিকে নানাভাবে সে নিজের করে নিতে চেয়েছিল সকালবেলায় তার নিয়মিত কাজ ছিলনিম্নশ্রেণীর লোকেদের ঘরেযাওয়া তাদের উপকার করার জন্য বা তাদের উপদেশ দেওয়ার জন্য নয় নিতান্ত দেখাসাক্ষাৎই উদ্দেশ্য গোরাকে তারাদাদাঠাকুরবলত কড়িবাঁধা হুঁকো দিয়ে আপ্যায়ন করত গোরা এমনিতে তামাক না খেলেও তাদের দেওয়া হুঁকোয় তামাক খেত  রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই দলের মধ্যে নন্দ গোরার সর্বপ্রধান ভক্ত ছিল নন্দ ছুতারের ছেলে বয়স বাইশ সে তাহার বাপের দোকানে কাঠের বাক্স তৈয়ারি করিত ধাপার মাঠে শিকারির দলে নন্দর মতো অব্যর্থ বন্দুকের লক্ষ কাহারো ছিল না ক্রিকেট খেলায় গোলা ছুঁড়িতেও সে অদ্বিতীয় ছিলছুতোরের ছেলে নন্দ ফাস্ট বোলার খেলার মাধ্যমে বর্ণভেদ গরিববড়লোকের সামাজিক পার্থক্য দূর করতে সচেষ্ট হল গোরাতাহার শিকার ক্রিকেটের দলে ভদ্র ছাত্রদের সঙ্গে এইসকল ছুতারকামারের ছেলেদের একসঙ্গে মিলাইয়া লইয়াছিল এই মিশ্রিত দলের মধ্যে নন্দ সকলপ্রকার খেলায় ব্যায়ামে সকলের সেরা ছিল ভদ্র ছাত্রেরা কেহ কেহ তাহার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল, কিন্তু গোরার শাসনে সকলেরই তাহাকে দলপতি বলিয়া স্বীকার করিতে হইত

ক্রিকেট আর ব্যায়ামের মাধ্যমে ভারতবর্ষীয় সমাজের একাংশের মধ্যে বদল এনেই গোরা থমকে যায়নি গোরার পরিকল্পনা বৃহত্তর সেপরিকল্পনার দুটি দিকএকদিকে ভারতীয় সমাজকে জানতেচিনতেবদলাতে হবে অন্যদিকে ইংরেজপক্ষীয়দের অপশাসনের প্রতিবাদ করতে হবে সে প্রতিবাদের রকম গোরার ক্ষেত্রে সর্বদা সর্বত্র মোটেই অহিংস প্রকারের নয় গোরা আর তার বন্ধু বিনয় হেমচন্দ্র্র নবীনচন্দ্রের কবিতা পড়ে উদ্দীপিত হয়ে সাহেবদের বিরুদ্ধে সহিংসপন্থা গ্রহণ করত এই উদ্দীপনায় ক্রিকেটও যে হতে পারে উপযুক্ত হাতিয়ার রবীন্দ্রনাথ, তা বিলক্ষণ জানতেন কলকাতার বাইরে মেলা উপলক্ষেএকদল ছাত্রের সহিত এখানকার স্থানীয় ছাত্রদলের ক্রিকেটযুদ্ধ স্থির হইয়াছে হাত পাকাইবার জন্য কলিকাতার ছেলেরা আপন দলের মধ্যেই খেলিতেছিলএমন সময় খেলতে খেলতে একজন আহত হয় মাঠের ধারেই বড় পুকুর তার জল যে খাবার জন্য মাত্র বরাদ্দ ছেলেরা তা জানত না, আহত সহযোদ্ধার পা পুকুরের জলে চাদর ভিজিয়ে তারা বেঁধে দিচ্ছিল সহসা ইংরেজ প্রশাসনের পুলিশের আগমন তারা ছেলেদের প্রথমেই অশ্রাব্য গালাগাল দিতে শুরু করল সুতরাং খন্ডযুদ্ধ লাগতে দেরি হল না ক্রিকেট খেলার ফলে গা তো গরম হয়েই ছিল

শুধু যে স্বাদেশিকতার বহরেই ক্রিকেটের বিস্তার যে নয়, এর সামাজিক প্রভাব যে অন্যরকম সে খবরও রবীন্দ্রনাথ রাখতেনবারোয়ারি মঙ্গলনামের লেখাটির কথা মনে পড়বেয়ুরোপে এই ক্ষমতা এবং মাহাত্ম্যের প্রভেদ লুপ্তপ্রায় উভয়েরই জয়ধ্বজা একই রকম, এমনকি, মাহাত্ম্যের পতাকাই যেন কিছু খাটো পাঠকগণ অনুধাবন করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন, বিলাতে অভিনেতা আর্ভিঙের সম্মান পরমসাধুর প্রাপ্য সম্মান অপেক্ষা অল্প নহে রামমোহন রায় আজ যদি ইংলন্ডে যাইতেন তবে তাঁহার গৌরব ক্রিকেটখেলোয়াড় রঞ্জিত সিংহের গৌরবের কাছে খর্ব হইয়া থাকিতমহাত্মা রামমোহনের চেয়ে ক্রিকেটার রঞ্জিত সিংহের আদর গুরুত্ব জনসমাজে বেশি এই কথাটা যে কী মর্মান্তিক রকমের সত্য, তা একালে ভারতীয় সমাজরাজনীতিতে বিলক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে ক্রিকেটার ফিল্মস্টাররা প্রতিভাবান প্রতিভার সূত্রে জনপ্রিয় ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে পারেন তবে ক্ষমতা আর প্রতিভা এক, মাহাত্ম্য আর এক জনসমাজ দুয়ের ভেদ গুলিয়ে ফেলে ফল ক্ষতিকর সন্দেহ নেই অভিনেতা আর ক্রিকেটারদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি টানাটানি করে রাজনৈতিক দলগুলি সামাজিক মঙ্গলের জন্য এঁদের দলে টানেন না, ভোটবাক্সে এঁদের জনপ্রিয়তার প্রতিফলন পড়ুক তাই উদ্দেশ্য জনসাধারণ অনেক সময়আশায় বাঁচে চাষাভঙ্গিতে ভাবেন এঁদের হাতেই বুঝি বারোয়ারি মঙ্গল হবে! এঁরা তো সবাই মহৎ নন, মঙ্গলের দায়িত্ব কেমন করে নেবেন! ফল যা হওয়ার তাই হয়

সৌজন্যে সংবাদ প্রতিদিন, কলকাতা