নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠা

4

দিপালী চক্রবর্তী

সেই প্রগৈতিহাসিক যুগ থেকেই নারীর অবস্থান হিন্দু ধর্মে দেখতে পাই। বেদে উষা দেবীর অবস্থানই জানান দেয় নারী, শক্তি-মেধায় কোন অংশেই কম নয়। তার অধ্যুষিত গোষ্ঠী কিভাবে প্রতিপালিত হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  অনেকে অভিযোগ করেন মনুসংহিতা নারী বিরোধী শাস্ত্র। আদি মনুসংহিতা পড়লে বলা যায় যে, মনুর মত ধর্মনেতা নারীর মর্যাদা দানে এত চমৎকার বিধান করেছেন তা অনেক নেতাই করেননি। এর একটি উদাহারণ মনুসংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ের শ্লোকঃ

যত্র সার্ব্যস্ত্র পূজ্যন্তে রসন্তে তত্র দেবতাঃ।

যত্রৈতাস্ত্র ন পূজ্যন্তে সর্ব্যান্তত্রাফলাঃ ক্রিয়ঃ ॥

(মনু ৩/৫৬)

অর্থাৎ যে সমাজে নারীদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয় সেই সমাজ উত্তোরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করে। আর যার নারীদের যোগ্য সম্মান করে না তারা যত মহৎ কাজই করুক না কেন তার সবই বৃথা।

বেদে বলা হয়েছে নারী ও পুরুষ একে ভিন্ন অপরে অসম্পূর্ণ। তাই ধর্ম কর্ম পতœীর সাথে মিলে করা কর্তব্য। (মনু ৯/৯৬) মনুসংহিতার ৯/১২ শ্লোকে বলা আছে, যে নারী নিজে আত্মরক্ষায় যত্মবতী নয়, তাকে পুরুষগণ ঘরে আটকে রাখলেও সে অরক্ষিত থাকে। কাজেই তাকে আটকে না রেখে আত্মরক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। স্ত্রী জাতির নিরাপত্তা তাদের সামর্থ্য ও মনোভাবের উপর নির্ভরশীল।

আমরা শক্তির আরাধনার জন্য দেবী শক্তির পূজা করি। বাস্তবেও নারীকে সম-অধিকার ও মর্যাদা দিয়ে অন্তঃপুরবাসিনী নারীদের দেবী নয় সমাজে মানুষ হিসেবে তার যোগ্য স্থানে নিয়ে আসতে হবে। বিদুষী গার্গী, মৈত্রেয়ী, মহাভারতের দ্রেীপদীর রাজনৈতিক জ্ঞানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তখনকার সমাজে নারীদের অবস্থান আমরা দেখতে পাই। সময়ের ব্যবধানে নারী হয়ে যায় অন্তঃপুরবাসিনী। তাদের বের করার দায়িত্বে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন রাজা রাম মোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কবিগুরু তো বাঙালিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন বাংলার নারীরা হীরে।

সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরাসরি বাস্তবে কর্মক্ষেত্রে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সন্মুখ সমরে অংশ নেয়া নারী, আমাদের অগ্রপথিক প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তাঁর আগে মেয়েরা ভিতর থেকে সাহায্য করত। অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা তার কর্মদক্ষতা দিয়ে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, নারীরা ভিতরে বাইরে সমানভাবে সফল। তাই তাঁর উপর মাস্টারদা সূর্যসেন গুরু দায়িত্ব দেন। আর বলেন যে, ধরা পড়লে যেন আত্মাহুতি দেন। প্রীতিলতা তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন। সেই অগ্রপথিকের হাত ধরে আমাদের তার অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রের মাঝে নিজেদের আসন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। এখনো রাষ্ট্রে ধর্মীয়ভাবে নারীর অধিকারে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। হিন্দু নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হলে কাজের পাশাপাশি তাকে দিতে হবে স্বামীর সম্পত্তির অধিকার। তাহলেই সে নিজেকে আর অবহেলিত মনে করবে না।

এই সম-অধিকারের যুগে নারী পুরুষ বৈষম্য দূর করে নারীকে রাষ্ট্রের কাছে মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে হবে। দূর করতে হবে লিঙ্গ বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, শ্রেণী বৈষম্য। আর তাতেই প্রতিষ্ঠিত হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

যারা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাদের অভিবাদন জানাই।

লেখক : মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক