আড্ডা। শব্দটি শুনলেই বইপড়া বাঙালি বুদ্ধদেব বসুর দ্বারস্থ হন। আড্ডা নিয়ে ‘উদ্বোধন’ পত্রের সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ ও চিন্তক গোপাল হালদারের লেখা রয়েছে। তবে বুদ্ধদেব বসু রচনাগুণে বাকিদের ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। আড্ডা বিষয়ক বহুপঠিত লেখাটিতে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অন্যান্য দেশের লোক বক্তৃতা দেয়, রসিকতা করে, তর্ক চালায়, ফুর্তি করে রাত কাটিয়ে দেয় কিন্তু আড্ডা দেয় না।’ আড্ডা জিনিসটা বুদ্ধদেব বসুর মতে সর্বভারতীয় কিন্তু বাংলাদেশের সজলতায় এর যথার্থ বিকাশ। বুদ্ধদেব আড্ডার লোকসংখ্যার সীমা নির্দেশ করে দিয়েছিলেন। নিচের সীমা তিন আর উপরের সীমা দশ কি বারো। তার বেশি হলে আড্ডাস্থল অ্যালবার্ট হল হয়ে ওঠে, আড্ডার প্রাণপাখি উড়ে যায়। বুদ্ধদেব বসুর এই লেখাটির সূত্রে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন কবিগুরু কি আড্ডা দিতেন ? এ প্রশ্নের উত্তর একবাক্যে না। কারণ রবীন্দ্রনাথকে যদি ‘কবিগুরু’ বলে মানতে হয় তাহলে তাঁর সঙ্গে আড্ডা চলে না, কথোপকথন চলতে পারে। সদালাপকেও আড্ডা বলা চলে না। কারণ আড্ডায় আলাপচারিদের সমমর্যাদাসম্পন্ন হওয়া বিধেয়। কবিগুরু হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে মানলে তাঁর সঙ্গে আর যাই হোক, আড্ডা জমে না।
কথাটা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথও মানতেন। তাঁর লেখায় ‘আড্ডা’ শব্দটি দুই অর্থে ব্যবহৃত। একটি অধিকরণ অর্থে অন্যটি কর্ম অর্থে। ‘কলিকাতা ম্যুনিসিপ্যালিটি কেবল দিশি লোকের আড্ডা হইয়া উঠিল।’ বা ‘ঐ গাছতলা ছিল ডাকাতের আড্ডা।’ – এই প্রয়োগগুলিতে আড্ডা অধিকরণ। বুদ্ধদেব বসু তো আড্ডা নামক কর্ম নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন, আড্ডাস্থলের নান্দনিক বিবরণও তিনি দিয়েছিলেন তবে নিতান্ত অধিকরণ অর্থে আড্ডা নিয়ে তাঁর আগ্রহ নেই। প্রশ্ন হল রবীন্দ্র–রচনায় সেই আড্ডা নামক কর্মটির বিবরণ কোথায় কীভাবে আছে? একটি বিবরণই এখানে লাগসই। ‘জীবনস্মৃতি’-তে বন্ধু ‘লোকেন পালিত’-এর কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্ররচনায় এসেছে আড্ডা।
ৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃরবীন্দ্রনাথ তাঁর একান্ত বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতেন, আড্ডা দিতেন না তিন–চারজন মিলে। আড্ডাপরায়ণতা তাঁর স্বভাবে নেই, কৈশোরে যৌবনে স্বভাবত তিনি অন্তর্মুখ। লোকেনের মতো কাউকে কাউকে পেলে অবশ্য খোলা মনেই গল্প করতেন। তাঁর আড্ডা দু’জনের গল্প, এর বেশি আড্ডা তিনি খুব একটা দিয়ে উঠতে পারতেন বলে মনে হয় না। তাঁর উপন্যাসেও বন্ধু–যুগলের উপস্থিতি। মহেন্দ্র–বিহারী (‘চোখের বালি’), গোরা–বিনয় (‘গোরা’), শচীশ–শ্রীবিলাস (‘চতুরঙ্গ’)। এক বন্ধু অন্য বন্ধুর কাছে সহজ। তার বেশি লোকের প্রয়োজন নেই।
‘য়ুনিভার্সিটি কলেজের লাইব্রেরিতে ছাত্র ও ছাত্রীরা বসিয়া পড়াশুনা করে; আমাদের দুইজনের সেখানে গল্প করিবার আড্ডা ছিল। সে কাজটা চুপিচুপি সারিলে কাহারও আপত্তির কোনো কারণ থাকিত না, কিন্তু হাসির প্রভূত বাষ্পে আমার বন্ধুর তরুণ মন একেবারে সর্বদা পরিস্ফীত হইয়াছিল, সামান্য একটু নাড়া পাইলে তাহা সশব্দে উচ্ছ্বসিত হইতে থাকিত। ৃ আমাদের কত পাঠরত প্রতিবেশিনী ছাত্রীর নীল চক্ষুর নীরব ভর্ৎসনাকটাক্ষ আমাদের সরব হাস্যালাপের উপর নিষ্ফলে বর্ষিত হইয়াছে তাহা স্মরণ করিলে আজ আমার মান অনুতাপ উদয় হয়।’
বুদ্ধদেব বসুর মত যদি মানতে হয় তাহলে রবি–লোকেন–এর এই কথালাপকে কি আড্ডা বলা যাবে? এখানে তো তিন নয়, দুই বন্ধু কথা বলছে। বুদ্ধদেব লিখেছেন আড্ডা হতে গেলে আড্ডাধারীদের সংখ্যা অন্তত তিন হওয়া চাই। রবীন্দ্রনাথ আর লোকেন তো দুই। সেজন্যই হয়তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘গল্প করিবার আড্ডা ছিল’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একান্ত বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতেন, আড্ডা দিতেন না তিন–চারজন মিলে। আড্ডাপরায়ণতা তাঁর স্বভাবে নেই, কৈশোরে যৌবনে স্বভাবত তিনি অন্তর্মুখ। লোকেনের মতো কাউকে কাউকে পেলে অবশ্য খোলা মনেই গল্প করতেন। তাঁর আড্ডা দু’জনের গল্প, এর বেশি আড্ডা তিনি খুব একটা দিয়ে উঠতে পারতেন বলে মনে হয় না। তাঁর উপন্যাসেও বন্ধু–যুগলের উপস্থিতি। মহেন্দ্র–বিহারী (‘চোখের বালি’), গোরা–বিনয় (‘গোরা’), শচীশ–শ্রীবিলাস (‘চতুরঙ্গ’)। এক বন্ধু অন্য বন্ধুর কাছে সহজ। তার বেশি লোকের প্রয়োজন নেই।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘আমার যৌবন’-এ কিংবা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর ‘কল্লোলযুগ’-এ তরুণ সাহিত্যমোদীদের যে আড্ডা দেওয়ার বিবরণ দিয়েছেন তেমন আড্ডা থেকে রবীন্দ্রনাথ দূরে থাকতেন। এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথের থেকে এগিয়ে রাখতে হবে। এমনিতে বঙ্কিমচন্দ্র খুবই রাশভারী। সহোদর সঞ্জীবচন্দ্রের মতো তিনি দিলখোলা ছিলেন না, তবে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনাকালে বন্ধুমহলে নানা বিষয়ে আড্ডা দিতেন। বঙ্কিম চিঠি লিখতেন কম, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাতে তাঁর ভাব বিনিময় হত। আর রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখতেন প্রচুর। ফলে যে কথা মুখের ভাষায় সামনা–সামনি উঠে আসার কথা তা অন্যভাবে ধরা দিত পত্রসাহিত্যে। এমন ভাবাই যায় আড্ডা দিতেন না বলেই হয়তো চিঠিতে একের সঙ্গে অপরের সহজ কথা বিনিময় সম্ভব হত রবীন্দ্রনাথ যথার্থ আড্ডাবাজ হলে এমন বিপুল পত্রসাহিত্য হয়তো বাঙালি পাঠকের কপালে জুটতই না।
আড্ডা না দিলেও খানিক আড্ডার মেজাজে একটা বই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে বইয়ের নাম ‘পঞ্চভূত’। তিন পুরুষ আর দুই মেয়ের মোট পাঁচজনের নানা বিষয়ের কথোপকথনের বই সেটি। তবে এ–বইকেও যথার্থ আড্ডাবাজ খারিজ করে দেবেন। বলবেন এ তো আড্ডা নয়, স্পষ্টই জানানো হয়েছে এ পাঁচ ভূতের সভা, সভার সভাপতি ভূতনাথ বাবু। একে আড্ডা বলে চালিয়ে দিলে আড্ডারসের অবমাননা হয়। কথাটি সত্য। এমনিতে উনিশ শতকে যাও রবীন্দ্রনাথকে আড্ডাবাজ হিসেবে দেখা সম্ভব ছিল বিশ শতকে আর তার উপায় রইল না। ব্রহ্মচর্যাশ্রম আর বিশ্বভারতীর দৌলতে রবীন্দ্রনাথ ক্রমে গুরুদেব হয়ে উঠলেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ভারে প্রণম্যতা পেলেন। অনুজ সাহিত্যিকেরা তাঁর রুদ্ধ পথ কাটতে উদ্যত হলেন যখন তখন মাঝে মাঝেই তাঁর সঙ্গে অনুজদের নানা কথা হয়েছে, তাকে কিন্তু আড্ডা বলার উপায় নেই। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে রবি ঠাকুরের কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই কৌতুক করেছেন কিন্তু অনুজদের সঙ্গে ঠিক আড্ডা দিতে পারেননি।
দেশে–বিদেশে যেতেন। সঙ্গী নানা সময়ে নানা জন। মজার কান্ডকারখানাও কম হত না। তবে সেই সমস্ত বিবরণকে আড্ডা বলতে আটকায়। কথা হচ্ছে, মজা হচ্ছে, মজার মধ্যে তারল্যও খানিক থাকে তবে সীমা থেকেই যায়। কিছুতেই আলাপচারীরা ভুলতে পারেন না ও ভুলতে দেন না সঙ্গে আছেন যিনি তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথায় যদি বাজেরও বাহুল্য থাকে, তবে তা সাধারণের আড্ডার বাজে–কথা নয়, রবীন্দ্রনাথের বাজে কথা। তার জাত গোত্র আলাদা।
কত নাম! দিশি ও বিলিতি! গান্ধী–আইনস্টাইন–সুভাষচন্দ্র–জহরলাল–বিধুশেখর–ক্ষিতিমোহন–এলমহার্স্ট–পিয়ারসন–প্রশান্তচন্দ্র–জগদীশচন্দ্র! এঁদের সঙ্গে কথা– যেন সব হীরকদ্যুতি। মন ঝলসে যায় ভাবনাদ্যুতিতে। তবে বুদ্ধদেব যাকে বলেছিলেন আড্ডার কাপড়ের আরাম– ‘ফর্শা নয়, অনেকটা ঢোলা, প্রয়োজন পার হয়েও খানিকটা বাহুল্য আছে, স্পর্শকোমল, নমনীয়’ সেই কাপড়ের আরাম তাঁর দিকে রবীন্দ্রনাথ তেমন করে খুব কম মানুষকেই দিতে চান। যাঁর যা স্বভাব, যাঁর যা পছন্দ!
সংবাদ প্রতিদিন–এর সৌজন্যে